Saturday 19 October 2013

আবার এসো অঞ্চলে

    গুনগুন ফাগুন হল শেষ, কুহু কুহু সারা - প্রয়াত মাধুরী চট্টোপাধ্যায়

  গতকাল (১৯.১০.২০১৩) দুপুর তিনটে নাগাদ, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।




               শৈশব  থেকেই মাধুরীর মূল আকর্ষণ সঙ্গীত - ছুটতেন চোঙা-লাগানো কলের গানের গাড়ির পিছনে! পরিবারেও ছিল সঙ্গীত চর্চার ঐতিহ্য।  গান শেখা শুরু, ন'দশ বছর বয়স থেকে - নারায়ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বন্দীপুর নিবাসী নারায়ণবাবু গান শেখাবার সঙ্কল্পে এসেছিলেন কলকাতায়, থাকতেন মাধুরীদের বাড়ির একতলায়, পেয়িং-গেস্ট হিসাবে। ক্লাস চলাকালীন প্রতিদিনই দরজার ধারে দাঁড়িয়ে গান শোনে ছোট্ট মাধুরী। তা দেখে, নারায়ণবাবুর আগ্রহেই গান শেখা শুরু। বছর কয়েক শেখার পরই একদিন মাস্টারমশাই বললেন, "যে কোনো ধরণের গানই গাইতে পারো কিন্তু ক্লাসিকাল না শিখলে, জমি তৈরী হবেনা।" শুরু হল প্রথমে হরিহর শুক্লার প্রিয় ছাত্র সুনীল সরকার ও পরে উমা দে'র কাছে রাগসঙ্গীতে তালিম। পাশাপাশি চলতে থাকল দুর্গা সেনের কাছে গীত, ভজন, রাগপ্রধান, ও রথীন ঘোষের কাছে কীর্তনের শিক্ষা।


               ১৯৫৫ সালে গীত, ভজন, রাগপ্রধান ও আধুনিক গানের অডিশানে পাস করে বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু। প্রথমদিকে, বাড়ির লোকের সঙ্গে যাওয়া সত্বেও, গার্স্টিন প্লেসের বেতারভবনে একরকম জোর করেই গুরু দুর্গা সেনকেও নিয়ে যেতেন মাধুরী - সাহেব ভূতের ভয়ে! ১৯৫৭-'৫৮ সাল নাগাদ, একদিন ওঁদের বাড়ি এসেছেন মেগাফোন কোম্পানির তৎকালীন ম্যানেজার, অসিত দত্ত - মাধুরীর গান শুনে চমৎকৃত! ওঁরই উদ্যোগে মেগাফোনে সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অডিশন দিয়ে, প্রসংসার সাথেই উত্তীর্ণ হলেন 'কুমারী মাধুরী বন্দ্যোপাধ্যায়'। 

                               নচিকেতা ঘোষের সুরে, ১৯৫৯ সালে রেকর্ড হল "অলি অমন করে নয়" আর "তোমায় আমায় প্রথম দেখা" - ১৯৬০-এ প্রকাশ পেতেই জনপ্রিয়তা পেল। স্মৃতিচারণে মাধুরী বলেছিলেন, "তোমায় আমায় প্রথম দেখা" গানটি দু'মাস ধরে প্র্যাকটিস্ করেছিলেন তিনি। প্রথমদিকে গানটির "কলিতে" অংশটা ঠিকমত গাইতে না পারায় বেশ নিরাশাতেও ভুগতে হয়েছিল!




               
             দ্বিতীয় রেকর্ডের জন্য ডাক পড়ায়  মেগাফোন কোম্পানিতে গিয়ে অবাক মাধুরী! তিনি শুনেছেন সলিল চৌধুরীর সুরে সদ্যপ্রকাশিত লতা মঙ্গেশকারের অসামান্য গান - সেই সলিলবাবুই কিনা বসে আছেন সঙ্গীত পরিচালকের আসনে - তাঁর সুরেই রেকর্ড হবে গান।  ১৯৬১ সালে, সলিল চৌধুরীর সুরে "নিজেরে হারায়ে খুঁজি" ও "এবার আমার সময় হল" গানদুটি সে বছরে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ গানগুলির অন্যতম বলে বিবেচনা করলেন শ্রোতৃকুল। এই রেকর্ড মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হয়ে মাধুরী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়। সলিলবাবু চেয়েছিলেন, বোম্বে পারি দিয়ে বলিউডের সঙ্গীতজগতে খ্যাতিমান হন মাধুরী - কলকাতায় কাজের চাপে আর শ্বশুরবাড়ির আপত্তিতে, সদ্য বিবাহিতা শিল্পী রাখতে পারেন নি সেই অনুরোধ।






               ১৯৫৫ সালে বেতারভবনে কিশোরী মাধুরীর অডিশন দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তৃতীয় রেকর্ডে তিনি প্রথম গাইলেন রবীনবাবুর সুরে। "ওগো শুনি তব বাঁশি" আর "জানিনা আজ প্রাণে মোর" গানদুটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হলে আদৃত হয়। এরপর বিখ্যাত বহু সুরকারের সুরে ও পরিচালনায় গান গেয়েছেন মাধুরী, যাঁদের মধ্যে অনিল বাগচী, প্রবীর মজুমদার, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রথীন ঘোষ, রতু মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু বিশ্বাস, প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে ১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান রেকর্ড করার কথা ঠিক হলেও, ওঁর মৃত্যুতে, গান আর শেখা হয়না। হেমন্তবাবুর সুরে গান গাইতে না পারা মাধুরীর জীবনের একমাত্র অপ্রাপ্তি, স্বীকার করেছিলেন শিল্পী স্বয়ং।


  

         ছায়াছবিতে নেপথ্যসঙ্গীতশিল্পী হিসাবে মাধুরী চট্টোপাধ্যায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ১৯৬৪ সালে, গুরু রথীন ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় "মহাতীর্থ কালিঘাট" ছবিতে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় অধিকারী, মানস মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে সমবেত সঙ্গীত ও "রাধাকৃষ্ণ" ছবিতে কীর্তনাঙ্গের গান পরিবেশন করে। পরের বছর রথীনবাবুর সুরেই গাইলেন "রূপ সনাতন" ছবিতে।

         গ্রামোফোন রেকর্ডের জগতে ততদিনে হিন্দুস্থান, মেগাফোন প্রভৃতি কোম্পানিগুলিকে পিছনে ফেলে জনপ্রিয়তায় বহুদূর এগিয়ে গেছে দ্যা গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (এইচ.এম.ভি.) সে কারণে, হিন্দুস্থান ও মেগাফোনের জনপ্রিয় শিল্পীরা প্রায় সবাই অধিক প্রচার ও জনপ্রিয়তার আশায় স্ব স্ব কোম্পানি ছেড়ে যোগদান করেছেন এইচ.এম.ভি-র শিল্পী হিসাবে। ওদিকে মাধুরীর ছায়াছবির গানগুলি কোনো কারণে মেগাফোনও রেকর্ডে প্রকাশ করছেনা। এমন সময় "উত্তর পুরুষ"(১৯৬৬) ছবিতে কন্ঠদানের জন্য মাধুরীর গুনমুগ্ধ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আহ্বান জানালেন শিল্পীকে। তবে শর্ত একটাই, এ ছবির গান রেকর্ডে যাতে প্রকাশ পায়, তার জন্য মাধুরীকে মেগাফোন ছেড়ে এইচ.এম.ভি-তে আসতে হবে।  মানববাবু ছাড়াও, সে সময়কার সব শিল্পীরাই মাধুরীকে এইচ.এম.ভি-তে  যোগদান করার নানা সুবিধার ইঙ্গিত দিলেন। মেগাফোনের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে শিল্পীর কষ্ট নিশ্চয়ই হয়েছিল, কিন্তু আনন্দের কারণও নেহাত কম থাকার কথা নয় - এইচ.এম.ভি-তে যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই রেকর্ডে প্রকাশ পেল "উত্তর পুরুষ" ছবির গান - "একবার ব্রজে চল ব্রজেশ্বর", যার মাধ্যমে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়! "উত্তর পুরুষ"-এর পর "শচী'মার সংসার"(১৯৭১), "স্বর্ণমহল"(১৯৮২), "তানিয়া" (১৯৮৭), প্রভৃতি অল্পসংখ্যক কিছু ছবিতে শোনা গেছে শিল্পীর কন্ঠ।



           রেকর্ডে নজরুলগীতিও প্রকাশিত হয়েছে মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত রেকর্ডে সুপ্রভা সরকারের সঙ্গীত পরিচালনায় ও কানাই দত্তের তবলা সঙ্গতে, নজরুল সৃষ্ট "গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা" গানটি ওঁর কন্ঠে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।



         
বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পীদের কথা বলতে গিয়ে, আনন্দবিহ্বল মাধুরী ফিরে যেতেন কিশোরবেলায় - যখন তিনি বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন সবে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠানে গাইবার আমন্ত্রণ এসেছে - কিছুতেই গাইবেন না! আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসুর মতো শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গাওয়া? অসম্ভব! অত সাহস নেই তাঁর। গাড়ি নিয়ে আলপনাদি সোজা চলে এলেন মাধুরীর বেলঘরিয়ার বাড়িতে - "তোকে গাইতেই হবে! তৈরী হয়ে নিয়ে এক্ষুনি আমার সাথে চল্!" প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় মাধুরী বলেছিলেন, "প্রতিমাদি, আমি, রাসবিহারিতে ছিলাম দশ বছর একসঙ্গে... একরকম মায়ের মতো আদর, স্নেহ পেয়েছি তাঁর মধ্যে... কী যে স্নেহ, কী ভালবাসা কী বলব!"



            আধুনিক গান সম্বন্ধে সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে রেখেছিলেন শিল্পী। রবীনবাবু বলেছিলেন, "দেখ্ মাধু, ক্লাসিকাল গানের ধারা আছে, বন্দিশ আছে, তান, বিস্তার, সরগম। আধুনিকে তো তা নেই। আধুনিক গান কিন্তু আরও শক্ত। তিন মিনিটের মধ্যে সব তোকে দেখিয়ে দিতে হবে..."

             না। গুনগুন ফাগুন তো শেষ হওয়ার নয়। তাই কুহু কুহুও গেয়ে উঠবে বারে বারে, নতুন সুরে। তারই মাঝে ধরা দিয়ে যাবেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায় - সুরে সুরে, গানে গানে...